Welcome to my personal website Campusbangla.com I am still developing this site day by day with new contains ( Bangla pdf Books, Kobita and other materials.). As a web developer I will be successful if someone visit my site and like as well. I am trying to portray Bengali culture through my site.

Thursday, 31 January 2013

স্বামী বিবেকানন্দ - প্রবন্ধ


সন্ন্যাস জীবনে স্বামী বিবেকানন্দ নামে পরিচিত নরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা কলকাতার সিমুলিয়া পল্লীর বিশ্বনাথ দত্ত এবং মা ভুবনেশ্বরী দেবী। তিনি মার কাছে শেখেন স্বধর্ম, বাবা পরিচয় করিয়ে দেন এক উদার সংস্কৃতির সঙ্গে। সাধারণ বিদ্যাশিক্ষার সঙ্গে তিনি সঙ্গীত ও ব্যায়ামেও পারদর্শী হন। যৌবনে তিনি ব্রাক্ষ্মসমাজ ও পাশ্চাত্য দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন। পরে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বি.এ. পাশ করে আইন পড়বার সময় পিতৃবিয়োগ হওয়ায় অর্থাভাবে তাঁকে অনাহারে পর্যন্ত দিন কাটাতে হয়েছিল। ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর গৃহী ভক্তদের অর্থানুকূল্যে তিনি অন্য গুরুভাইদের সঙ্গে বরানগরে প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ স্থাপন করেন। ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দের মাঝামাঝি পরিব্রাজনায় বেরিয়ে ভারত ও ভারতবাসীদের প্রতক্ষ পরিচয় লাভ করেন। এই সময়ে তিনি নানান শাস্ত্রও অধ্যয়ন করেন।
১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে তিনি শিকাগো ধর্ম মহাসভায় হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মাদ্রাজবাসী ও অন্যান্য বন্ধুদের সাহায্যে আমেরিকায় যান। সেপ্টেম্বরে এই সভার অধিবেশনে স্বামীজির বক্তৃতার ফলে ভারতের ধর্মমত ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে বিদেশীদের শ্রদ্ধা বহুগুণে বেড়ে যায়। আরও কিছুদিন ইউরোপে ও আমেরিকায় থেকে তিনি বক্তৃতা, শাস্ত্রব্যাখ্যা, বইলেখা ও ব্যক্তিগত আলোচনার মধ্যে দিয়ে ভারতীয় জীবন ও চিন্তাধারা সম্বন্ধে বিদেশীদের ভ্রান্ত ধারণা দূর করার কাজে নিযুক্ত থাকেন। ১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দে ভগিনী নিবেদিতা বিবেকানন্দকে সর্বপ্রথম দেখেন। স্বামীজির বাণী তাঁর হৃদয়ে অসামান্য প্রভাব বিস্তার করে। ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দে তিনি স্বামীজির আহবানে ভারতে আসেন। ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে বিবেকানন্দ স্বদেশে ফেরেন আর দেশবাসীর কাছ থেকে তুমুল সম্বর্ধনা পান।
বিবেকানন্দ এক নবজাগরণের বাণী শুনিয়ে ও নতুন কর্মপস্থার নির্দেশ দিয়ে ভারতের আত্মাকে সমগ্ররূপে উদ্বোথিত করেছিলেন। রাজনীতির ক্ষেত্রে নিজেকে না জড়ালেও তাঁর বক্তৃতা ও রচনা তেজ, বীর্য, কর্তব্যপরায়ণতা, স্বদেশপ্রেম, স্বাধীনতার আকাঙক্ষা, ভারতের ভাবী সম্ভাবনা ও অতীত মহিমার গৌরবানুভবের বার্তা প্রতিনিয়ত ধবনিত করে দেশের যুবকদের প্রাণে ও রাষ্ট্রজীবনে এক অভূতপূর্ব অনুভূতি ও উদ্বোধন এনেছিল। তিনি রাষ্ট্রজীবনে স্বাধীনতার দ্বার অর্গলমুক্ত করেছিলেন। তিনি ছিলেন সাম্যের বার্তাবহ, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত। ধর্ম ও সমাজের যুক্তিহীন চাপে জাতি কর্মশক্তি হারাবে এটা বিবেকানন্দের কাছে অসহ্য ছিল।
স্বামী বিবেকানন্দ সমাজসংস্ফারের বিরোধি না হলেও ভাঙবার পথে চলতে চাইতেন না। শিক্ষা ও সংস্কৃতির সাহায্যে নবীন জীবন গড়ে তোলাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। তিনি গতানুগতিকতার বিরোধী ছিলেন কিন্তু ভারতের শাশ্বত আত্মাকে অস্বীকার করেননি। তাঁর মতে ভারতের সমাজ ধর্মভিত্তিকা কিন্তু সে ধর্ম আচারগত নয়; এটা সর্বসমাজের, সর্বকালের, সর্বমানবের অন্তর্নিহিত চরম সত্য-দেশকালপাত্রানুযায়ী এর বিকাশ বিভিন্ন।
তিনি বুঝেছিলেন, বাল্যবিবাহ, অস্পৃশ্যতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে শক্তিক্ষয় করার চেয়ে শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিয়ে মানবমনকে পরিশীলিত করে উদারভুমিতে তুলে নিলে নীচতা ও ক্ষুদ্রতা সহজেই দূর হবে। শিক্ষার ফলে নারীসমাজ স্বাধীনভাবে নিজেদের সমস্যার সমাধান করবে। সে শিক্ষা হবে সর্বতোমুখী-দৈহিক, মানসিক, আখ্যাত্মিক এবং তা মানবের অন্তরাত্মাকে বিকশিত করবে।
বিবেকানন্দের মতে জাতীয় জীবনে উপনিষদের ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত রেখে বাইরের জগত থেকে ভাবধারা ও কর্মকৌশল আহরণ করতে হবে। বিজ্ঞান, সংঘবদ্ধভাবে কার্যপরিচালনা, উদার সামাজিক দৃষ্টি ইত্যাদি আধুনিক জগতের অবদানকে অস্বীকার করলে চলবে না। তিনি পাশ্চাত্যবাসীকে বলতেন, ভারত শুধু বিদেশীদের দ্বারে ভিখারী নয়, অপরকে শেখাবার মত উদার আধ্যাত্মিক সম্পদ ও শাশ্বত সত্যভূমিতে প্রতিষ্ঠিত সভ্যতারও সে অধিকারী। তিনি চাইতেন, ভারতবাসী সাহসভরে ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে সসম্মানে বিদেশীদের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করুক।
বিবেকানন্দের মতে ত্যাগ ও বৈরাগ্যই ভারতের চিরন্তন আদর্শ। তিনি ভারতের ইতিহাসে সমাজ সেবার এক নতুন অধ্যায় রচনা করেন। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রদর্শিত শিবজ্ঞানে জীবসেবার উদ্দেশ্যে তিনি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন (১৮৭৯ খ্রী) প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে সফল কথ্যভাষায় তিনি অন্যতম প্রথম প্রচারক। তাঁর মূল ইংরেজী ও বাংলা রচনাবলী বহু অনুদিত হয়েছে।
১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে তিনি আবার পাশ্চাত্য দেশে যান এবং আগের বারের মতই প্রচারে সফলতা লাভ করেন। বিদেশে কয়েকটি স্থায়ী বেদান্ত কেন্দ্র স্থাপন করে ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দের শেষে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দের ৪ জুলাই বেলুড় মঠে তিনি দেহত্যাগ করেন।
বিবেকানন্দ বহু বই লিখেছিলেন। তাঁর সমগ্র ইংরেজী রচনাবলী আট খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রধান বইগুলি হলঃ 'পরিব্রাজক' (১৯০৩ খ্রী); 'ভাববার কথা' (১৯০৫ খ্রী); 'বর্তমান ভারত' (১৯০৫ খ্রী); 'প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য'; Karmayoga; Rajayoga; Jnanayoga; Bhaktoyoga।

স্বামী বিবেকানন্দ-একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ


(১)
স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে লেখার সমস্যা অনেক-যদিও তার রচনাবলী আমি খুব ছোটবেলা থেকে পড়ছি। তার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যায়তনেই আমার শিক্ষা- তবুও বিবেকানন্দকে নিয়ে মৌলিক কিছু চিন্তা লিপিবদ্ধ করা বেশ কঠিন কাজ। মূল সমস্যা এই যে, বিদেশে যাকে ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিভংগীতে প্রবন্ধ লেখা বলে, সেই ধরনের লেখা বিবেকানন্দের ওপর নেই। বিবেকানন্দের জীবনী ভাষ্যকাররা মহান বিবেকানন্দর সন্ধানেই লিখে গেছেন। অবস্থা এত খারাপ, একবার বিবেকানন্দর ওপর সব থেকে বড় স্যোশাল ফোরামে আমাকে তাড়ানো হয় এই অপরাধে যে আমি একটি নিরীহ তথ্য দিয়েছিলাম- শেষ জীবনে বিবেকানন্দ অনুতাপ করেছিলেন, কেন গৃহী না হয়ে সন্নাস্যী হয়েছেন-আরেকবার জন্মালে আর সন্ন্যাসী হবেন না, বে-থা করে গৃহীই হবেন।
তথ্যটি সত্য। শুধু তাই না, বিবেকানন্দ নিজের মায়ের দেখভাল করতেন, ভাইএর চাকরির জন্যে তদারকি করেছেন এবং পৈত্বৃক বসত বাড়ির শরিকি মামলার সাথেও ছিলেন। এর কোন কিছুই যদিও তাকে ছোট করে না, তবুও তার ভক্তবৃন্দ তাকে “সাইক্লোন সন্ন্যাসী” হিসাবেই দেখতে পছন্দ করেন বেশী।
সমস্যা আরো বেশী গভীরে। গান্ধী, নেহেরু, নেতাজি থেকে আপামর মহান ভারতীয় নেতারা যে “একটি” ব্যক্তিতে আপ্লুত ছিলেন তিনি বিবেকানন্দ। সাম্প্রতিক অতীতের প্রায় সবকটি জরিপে,তিনিই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভারতীয়-গান্ধীর থেকেও স্বামীজি বেশী জনপ্রিয়।
তার বাণী ভারত সহ পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িতে দিতে কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় ১৫০ কোটি টাকা খরচ করবে এই বছরে। শুধু সেকালের টাটা রা না, একালেও ভারতের প্রায় সব সবশ্রেণীর নেতাদের ( কর্পরেট, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ) প্রথম পছন্দের নাম স্বামীজি। ডান, বাম, হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্ঠান প্রায় সব শ্রেনীর লোকের কাছেই তিনি প্রিয় ব্যক্তিত্ব। নহেরু, গান্ধীকে নিয়ে অনেক মতভেদ। ভারতীয় জাতিয়তাবাদিরা এদের পছন্দ করে না। বিবেকানন্দকে নিয়ে কোন সমস্যা নেই। প্রবীর ঘোষের মতন হাতে গোনা কয়েকজন যুক্তিবাদি বা নরসিংহমের মতন গবেষক ছারা, আর কেওই সেই অর্থে বিবেকানন্দের সমালোচনা করেন নি।
(২)
কিন্ত এখান থেকেই আমার প্রশ্ন শুরু। বিবেকানন্দ ভারতকে বা এই পৃথিবীকে কি দিয়ে গেছেন, যে আজকে সবাই তাকে সর্বকালের সেরা ভারতীয় বলে মেনে নিচ্ছে?
তিনি দর্শন শাস্ত্রে মৌলিক কোন অবদান রাখেন নি। প্রাচীন ভারতীয় দর্শনকে, আধুনিক মোরকে হাজির করেছেন। এটা ঠিক বিবেকানন্দ রচনাবলী না পড়লে ভারতীয় দর্শন গভীরে বোঝা সম্ভব না। ধর্ম জিনিসটা ঠিক কি-সেটাও বিবেকানন্দ পড়েই আমার শেখা। তিনি একজন আধুনিক ভাষ্যকার। এই পর্যন্ত।
বিবেকানন্দের রাজনৈতিক এবং সমাজ চিন্তা বালখিল্যতা বললে কম বলা হবে।
প্রথমে তার রাজনৈতিক চিন্তার বিশ্লেষনে আসব। ভারতের উন্নতির জন্যে বৃটিশ শাসনের হাত থেকে মুক্তি দরকার-সেই নিয়ে তার সংশয় ছিল না। বৃটিশ ভারতের রাজনৈতিক কাঠামোতে কিভাবে দরিদ্র ভারতীয়রা নিষ্পেষিত হচ্ছে, নিচূ জাতের লোকেরা শোষিত হচ্ছে, সেই নিয়ে তিনি সরব ছিলেন। সেই জন্যেই তিনি ভারতীয় বিপ্লবীদের মন্ত্রগুরু। কিন্ত মুক্ত ভারতের রাজনৈতিক ভিত্তি কেমন হবে-তার জন্যে জাপানকে আদর্শ মনে করতেন। জাপানের ন্যাশালিস্টিক ফ্যাসিজম তার ভাল লেগেছিল। অতীতকে স্মরণে রেখে, জাতিগর্বে উৎসাহিত হয়ে, বস্তুবাদি উন্নতি করতে হবে। জাপানের মতন “ডিসিপ্লিনড” জাতি চাইছিলেন তিনি।
” Only I want that numbers of our young men should pay a visit to Japan and China every year. Especially to the Japanese, India is still the dreamland of everything high and good. And you, what are you? … talking twaddle all your lives, vain talkers, what are you? Come, see these people, and then go and hide your faces in shame. A race of dotards, you lose your caste if you come out! Sitting down these hundreds of years with an ever-increasing load of crystallized superstition on your heads, for hundreds of years spending all your energy upon discussing the touchableness or untouchableness of this food or that, with all humanity crushed out of you by the continuous social tyranny of ages – what are you? And what are you doing now? … promenading the sea-shores with books in your hands – repeating undigested stray bits of European brainwork, and the whole soul bent upon getting a thirty rupee clerkship, or at best becoming a lawyer – the height of young India’s ambition – and every student with a whole brood of hungry children cackling at his heels and asking for bread! Is there not water enough in the sea to drown you, books, gowns, university diplomas, and all?”
অর্থাৎ তার মতবাদ এই রকম- অভুক্ত জাতিকে আগে খেতে দিতে হবে। ভারতের ধর্মীয় সংস্কার এবং অহংকার ছেরে, আগে জাতিকে খাওয়ানো পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পেটে ভাত না থাকলে, বস্তুবাদি উন্নতি না হলে, সেই জাতির আত্মমর্যাদা থাকে না। সেই জন্যে জাপানের থেকে শেখ!
আপাত দৃষ্টিতে বিবেকানন্দের এই “মহান ভারত সত্ত্বার” শক্তিশালী লেখনীতে আমিও উদ্বেলিত হতাম। কিন্ত সমস্যা হচ্ছে এই, ইউরোপ, জাপানে ফ্যাসিজিমের উত্থানের পেছনেও ঠিক এই ধারনাই কাজ করেছে। রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে জাতিকে গণউত্থানের এই চেষ্টা ফ্যাসিজমের ধাত্রীগৃহ এবং জাপানে উনি যেটা দেখেছেন সেটা একটা প্রাক-ফ্যাসিস্ট সমাজ। তার লেখাতে গণতান্ত্রিক ভারত অনুপস্থিত। বরং বিবেকানন্দের ভারতের সাথে “ফ্যাসিস্ট জাপানের” মিল পাওয়া যাচ্ছে। তার রাজনৈতিক ধারনাতে সবথেকে বেশী অনুপ্রাণিত ছিলেন নেতাজি। এবং নেতাজির মধ্যেও ফ্যাসিজমের ভূত এমন ভাবে চেপে বসেছিল, তিনি হিটলারের সহযোগী হতে রাজী হলেন। নেতাজি জার্মানীতে তিন বছর ছিলেন (১৯৪১-৪৩)-এবং এমন একটা সময়ে যখন জার্মানী গোটা ইউরোপকে ধর্ষন করছে। এর পরেও তিনি অবলীলা ক্রমে নাৎসিদের সাথে একসাথে থাকলেন তিন বছর কারন ফ্যাসিজমের প্রতি তার দুর্নিবার আকর্ষন ছিল। নেতাজীর রচনাবলি পড়লে পরিস্কার হয়, তিনি ছিলেন বিবেকানন্দের রাজনৈতিক মানস সন্তান। তবে আমার এই সিদ্ধান্তও হবে অকালপক্ক-সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।
এবার আসি আমেরিকান সমাজ প্রসঙ্গে। স্বামীজি দেখলেন, আমেরিকাতে ব্যবসায়ীরা সমাজ গড়ে-তারাই সব থেকে বেশী সন্মান পায়। আর ভারতে ব্যবসায়ী সমাজকে সঙ্গত কারনেই চোর ডাকাতের সাথে তুলনা করা হয়। সেই অবস্থা আজকে ১০০ বছরেও বদলায় নি। কারন আমেরিকাতে ধণতন্ত্র এসেছে কৃষকদের বণিক হিসাবে রূপান্তরের সাথে সাথে। আর ভারতের ধনতন্ত্রে বণিক শ্রেনী পরজীবি একটা কমিউনিটি যা বৃটিশরা তৈরী করে দিয়ে গিয়েছিল। আমেরিকান ধণতন্ত্রের সমস্ত ভালদিক গুলি তার চোখে পড়ল এবং তার উচ্ছাসিত প্রশংসা করেছেন তিনি। আমেরিকান লিবার্টিকে বা মানবমুক্তিকে উন্নতির প্রথম সোপান হিসাবে ঘোষণা করলেন।
ব্যাপারটা হল এই যখন যেটা ভাল লেগেছে, সেটাকেই তিনি মডেল করে দিতেন। জাপানের তিনি উচ্ছাসিত প্রসংশা করেছিলেন-কিন্ত জাপানিজরা সেই সময় মোটেও মুক্ত সমাজ ছিল না। আমেরিকাতে গিয়ে তিনি যা বলেছেন, সেটা মানতে গেলে, জাপানের সমাজের মতন নিকৃষ্ট সমাজ নেই-কারন তারা খুবই ফ্যাসিস্ট এবং টোটালাটারিয়ান রিপাবলিকে বিশ্বাস করত। আবার আমেরিকার মতন মানব মুক্তি দিতে গেলে, আমেরিকান ব্যক্তিস্বতন্ত্রবাদকেও মেনে নিতে হয় যা ভারতীয় দর্শনের সামাজিক কর্তব্যের সম্পূর্ন বিপরীত। এই সাথে আমেরিকান ব্যাক্তি স্বতন্ত্রবাদ আর ভারতীয় দর্শনকে মহান করতে সত্যিই মার্কেটিং এর মহান ক্ষমতা লাগে!
মোদ্দা কথা সামাজিক দর্শনের ব্যাপারে তার লেখাযোখা প্রায় শ্লোগান সর্বস্য। অভিজ্ঞতা নির্ভর। এম্পিরিসিজম থেকে স্ট্রাকচারালিজমে তিনি যান নি। গভীরে তিনি ঢোকেন নি- গভীরে ঢোকার মতন রাজনৈতিক, সামাজিক বা ঐতিহাসিক জ্ঞান তার ছিল বলে মনে হয় নি।
এই ধরনের পরস্পর বিরোধিতা বিবেকানন্দ চরিত্রের ছত্রে ছত্রে। তাতে অসুবিধা নেই। এর থেকে বোঝা যায় তিনি মুক্তমনের অধিকারি ছিলেন, তার মনে দ্বন্দ ছিল। এবং মনে দ্বন্দ থাকাই মনের উন্নতির প্রাথমিক শর্ত। নিজের অভিজ্ঞতার কাছে তিনি সৎ থেকেছেন। কিন্ত রাজনৈতিক বা সামাজিক দর্শনের চর্চা তিনি গভীরে গিয়ে করেন নি।
(৩)
এবার আরেকটি বিতর্কিত টপিকে আসি। নারীমুক্তি নিয়ে বিবেকানন্দের ভাবনা।
ইউরোপ এবং আমেরিকাতে তার শিষ্যর থেকে শিষ্যা বেশী ছিল। নারী মুক্তি এবং নারীর অধিকারের সাম্যতা নিয়ে তিনি দেদারসে শ্লোগান দিয়েছেন। এবং বেদান্তের চোখে নারী-পুরুষ সমান সেটা তার লেখাতে অনেকবার এসেছে। কিন্ত হিন্দু ধর্মে নারীর অবস্থান বা সব ধর্মে নারীর অবস্থান এত বাজে কেন-সেই নিয়ে কোন বিশ্লেষন তিনি করেন নি। করলে, ধর্মের সাথে ঐতিহাসিক সামাজিক শক্তির গুলির বিন্যাস তার চোখে পড়ত। বরং এই ব্যাপারে তার লেখালেখি অনেকটাই চটকদারি মন্তব্য-
The soul has neither sex, nor caste nor imperfection.”
“The best thermometer to the progress of a nation is its treatment of its women.”
” There is no chance for the welfare of the world unless the condition of women is improved.”
“Woman has suffered for aeons, and that has given her infinite patience and infinite preserverance.”
“The idea of perfect womanhood is perfect independence.”
এরপরেই আবার লিখলেন, ভারতে “নারীর” আদর্শ হচ্ছে মা-ইউরোপে “স্ত্রী”।
আরো লিখলেন, ভারতে নারীকে দেবীজ্ঞানে গৃহে পুজো করা হয়। যদিও বাস্তব হচ্ছে, ভারতে সেই সময় এবং কিছু কিছু সমাজে এখনো নারীর অবস্থান গৃহের গাভীর থেকে কিছু কম। গৃহবধূ হত্যায় ভারত সবার ওপরে। পৃথিবীতে প্রায় ৫৪০ রকমের “বিবাহের” সন্ধান পাওয়া গেছে-এর মধ্যে মোটে চার রকমের বিবাহে বরকে পণ দেওয়া চালু আছে। ভারতীয় সমাজ তাদের অন্যতম। এবং ভারতে মেয়েদের এই বাজে আর্থসামাজিক অবস্থানের জন্যে হিন্দু ধর্মের দায় সব থেকে বেশী।
হিন্দু ধর্মে জাতিভেদের বিরুদ্ধে বিবেকানন্দ যদিও বা কখনো সখনো লিখেছেন ( আবার বিদেশে জাতিভেদকে সমর্থন ও করেছেন ) হিন্দু ধর্মে নারীর করুণ অবস্থানের বিরুদ্ধে তিনি এক লাইন ও লেখেন নি। হিন্দু সমাজে নারী দুরাবস্থা নিয়ে অবশ্যই লিখেছেন। কিন্ত তার উৎসস্থল যে হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলি সেটা স্বীকার করেন নি, বরং এটাই দেখানোর চেষ্টা করেছেন, আদি বৈদিক সমাজে নারীর স্থান ছিল উঁচুতে- ব্রাহ্মনদের চক্রান্তেই এই অবস্থানের অনুন্নতি
In what scriptures do you find statements that women are not competent for knowledge and devotion? In the period of degeneration, when the priests made the other castes incompetent for the study of the Vedas, they deprived the women also of all their righ ts. Otherwise you will find that in the Vedic or Upanishadic age Maitreyi, Gargi, and other ladies of revered memory have taken places of Rishis through their skill in discussing about Brahman. In an assembly of a thousand Brahmans who were all erudite in the Vedas, Gargi boldly challenged Yagnavalkya in a discussion about Brahman. Since such ideal women were entitled to spiritual knowledge, why shall not the women have same privilege now? What has happened once can certainly happen again. History repeats itself. All nations have attained greatness by paying proper respect to women. That country and that nation which edo not respect women have never become great, nor will ever be in future. The principal reason why your race h! ! ! ! as so much degenerated is that you have no respect for these living images of Shakti. Manu says, “Where women are respected, there the gods delight; and where they are not, there all works and efforts come to naught.” There is no hope of rise for that fam ily or country where there is no estimation of women, where they live in sadness. (V7. p.214-15)
সমস্যা হচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন সমাজ আসে নি যা পুরুষবাদি ছিল না। অধিকাংশ নৃতত্ত্ববিদদের মতে অতীতের নারীবাদি সমাজের কল্পনা একধরনের মিথ [১]।
নারীবাদের উত্থান মূলত শিল্প বিপ্লবের সাথে এবং শিশুমৃত্যু হার কম হওয়ার সাথে সাথে। যার জন্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর সময় থেকে নারীরা কাজে যাওয়া শুরু করে। সব ধর্মই নারীকে ঘরে ঢুকিয়েছে-কারন সমাজের রিপ্রোডাক্টিভ ফিটনেস বজায় রাখতে সেটাই দরকার ছিল। হিন্দু ধর্ম কোন কালেই তার ব্যতিক্রম ছিল না- বরং তা পুরুষবাদি সমাজের উজ্জ্বল উদাহরণ।
মোটামুটি বিবেকানন্দ জীবনীতে যেটুকু দেখছি- বিদেশী নারীর কাছে তিনি নারীবাদি, হিন্দুর কাছে তিনি হিন্দু, বিদেশীদের কাছে তিনি আধ্যাত্মিক, জাপানীদের কাছে তিনি জাপানের জাতিয়তাবাদের ভক্ত!
মোদ্দা কথায়, হিন্দু ধর্মের দোষগুলিকে ঢেকে যেভাবে তিনি হিন্দু ধর্মের মার্কেটিং করেছেন, তা এক কথায় অসাধারন।
(৪)
এর পরেও আমি লিখব বিবেকানন্দ কিছু কিছু দিকে সত্যিই অসাধারন ছিলেন। সেটি হচ্ছে তার সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং মানুষকে ভাল কাজের জন্যে অনুপ্রেরিত করার ক্ষমতা। মানবিক শক্তিগুলির এবং গুণের বিকাশের জন্যে তিনি জ্ঞানের থেকেও উপলদ্ধির ওপর জোর দিতেন। সফল সংগঠক হতে গেলে মার্কেটিং করার দক্ষতা লাগেই এবং তার কাছে বিশুদ্ধ জ্ঞানের প্রত্যাশা করাটা ঠিক না। মানবসেবায় সফল সার্থক বিবেকানন্দকে মেনে নিতে আমার আপত্তি নেই। আপত্তি আছে “সমাজ বিপ্লবী, স ংস্কারক” বিবেকানন্দকে মেনে নিতে।
আমার মূল আপত্তি অন্ধ বিবেকানন্দ ভজনায়। বিবেকানন্দ সংস্কার মুক্ত, নির্ভীক ভারত চেয়েছিলেন। তার সাধ শতবর্ষে যে ভারত আমরা পাচ্ছি, সেই ভারত কিন্ত আজো অন্ধ কুসংস্কারে নিমজ্জিত। উত্তর প্রদেশে ভোট হচ্ছে জাতের ভিত্তিতে। আজও। বরং পশ্চিম বঙ্গে জাতপাত তুলনামূলক ভাবে অনেক কম-এবং সেই কমার পেছনে বাংলাতে বাম আন্দোলনের ভূমিকা আছে। বিবেকানন্দের প্রচার বা বাণীতে ভারতের জাতিভেদ বা হিন্দু ধর্মের বজ্জাতি যার বিরুদ্ধে বিবেকানন্দ সরব ছিলেন-কিছুই কমে নি। বধূহত্যা অব্যাহত।
তাহলে বিবেকানন্দের ভুলটা কোথায় ছিল? কেন তার জাতিভেদ মুক্ত, সাম্যের আদর্শে দীক্ষিত নীর্ভিক ভারতের আজও জন্ম হল না?
কারনটা এই যে বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্মকে আক্রমন করেন নি। বরং লোককে আরো হিন্দু ধর্মে গর্ব অনুভব করতে বলেছেন। তার চিন্তায় হিন্দু ধর্ম ভাল- সমাজ তাকে বাজে বানিয়েছে। এগুলি, যেকোন সমাজ বিজ্ঞানীর কাছে অসম্ভব বালখিল্য চিন্তা। ফুকোর ক্ষমতার তত্ত্ব দিয়ে এই ব্যাপারটা দেখলে দেখা যাবে বিবেকানন্দ ” কেন্দ্রীয় শক্তি” হিসাবে সেই হিন্দু ধর্মের কথাই বলছেন। এই ধরনের চিন্তাতে “ধর্মের বিরুদ্ধে” রাজনৈতিক শক্তিগুলি দুর্বল হয়। যেটা মুসলিম দেশগুলিতে আরো বড় সমস্যা। কোরান ভাল, মুসলমানরা খারাপ- এই ধরনের চিন্তা আসলেই কোন ধর্ম বিরোধি রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দিতে পারে না। আর ধর্ম বিরোধি রাজনৈতিক শক্তির জন্ম না হলে, কোন দেশের ধর্মীয় সংস্কার সম্ভব না। যেটা ভারতের রাজনীতিতে সব থেকে বড় বাস্তব। এখানের গোবলয়ে মার্ক্সীয় পার্টিগুলিকেও জাত ধর্মের সমীকরণ মানতে হয়।

Wednesday, 30 January 2013

"আকাশলীনা" কবিতাটির সমালোচনা


"সুরঞ্জনা ,অইখানে যেয়োনাকো তুমি...."

বেশিরভাগ বাঙ্গালীই এ কবিতার অন্তত দুটি লাইন শুনেছেন। “সুরঞ্জনা অইখানে যেওনাকো তুমি, বলোনাক
কথা অই যুবকের সাথে” আমার মতে বাংলা কবিতার সর্বাধিক পঠিত,সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত এবং দূর্ভাগ্য
বশত সবচেয়ে কম বিশ্লেষিত পংক্তি। বহুব্যবহারে আবেদন হারিয়ে ফেলা, আবেগের উচ্ছাসে বিবেচনাবোধ 
কাড়তে ব্যর্থ হওয়া এই “আকাশলীনা” কবিতাটি নিয়েই আজ কিছু কথা।যারা কবিতাটিকে হৃদয় এবং বুদ্ধি
দিয়ে নিজের ভেতর ধারণ করেছেন তারা তাদের ভাবনাটুকু আমাকে জানালে এবং যারা কবিতাটিকে নিতান্তই
 ত্রিভূজ প্রেমের কবিতা হিসেবে মনে করেছেন অথবা করছেন তারা একটু নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে কবিতাটিকে
 দেখলে বাধিত হব। কবিতাটি গত একমাস ধরেই আমাকে বেশ ভোগাচ্ছে।
-----
সুরঞ্জনা ,অইখানে যেয়োনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনাঃ
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে , ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূর - আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।
কী কথা তাহার সাথে? -তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মত তুমি আজ:
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস:
বাতাসের ওপারে বাতাস-
আকাশের ওপারে আকাশ।
(আকাশলীনা – জীবনানন্দ দাশ)
-------
আপাতদৃষ্টিতে কবিতাটি বিস্ময়কররকম সরল। জীবনানন্দীয় দূর্বোধ্যতা, অদ্ভুত উপমার আরো ততধিক অদ্ভুত
প্রয়োগ, “মতো” শব্দটির যথেচ্ছ ব্যবহার, ইতিহাসঘনিষ্ঠ দুঃসাহসী চিত্রকল্প, মৃত্যু আর অন্ধকারের ব্যতিক্রমী বন্দনা
এককথায় সকল জীবনানন্দীয় অনন্যতা থেকে এটি প্রথমদর্শনে মুক্ত বলেই মনে হয়।স্পষ্টতই শাশ্বত প্রেমের চিরায়ত
 সংগী বিরহ অথবা বিরহবিষয়ক কবিতা এটি।কবিতার পাত্র-পাত্রী তিনজন- কবি নিজে , সুরঞ্জনা এবং জনৈক
যুবক; অর্থাৎ সেই আমি, তুমি ও সে। আমাকে ছেড়ে অন্য কারো সাথে সুরঞ্জনা অনেকদূরে হারিয়ে গেছে আর
নক্ষত্রের রুপালী আগুনভরা রাতে আমি তাকে আবার ফিরে আসতে আহবান করছি -কবিতাটির কবি কে এটা
না বলে দিলে যে কেউ এই ব্যখ্যাটিই দাঁড় করাবেন; আসলে সাধারণভাবে এর বাইরে বেশি কিছু মনে হয়ও না।
কিন্তু এই সরলীকৃত ব্যাখ্যায় বাদ সাধে কবির নাম, তার অপরাপর কবিতা(ভুলে গেলে চলবে না এই কাব্যগ্রন্থটি
কবির পরিণত বয়সের রচনা এবং এতেই রয়েছে জীবনানন্দের দূর্বোধ্যতম কবিতা “গোধূলিসন্ধির নৃত্য”) ।
আরেকটু তলিয়ে দেখলে আলোচ্য কবিতার কয়েকটি পংক্তি এবং শব্দও কিছু জবাব না জানা প্রশ্নের জন্ম দেয়ঃ
১) সুরঞ্জনা কি কারো নাম নাকি নামবিশেষণ?
২) কবি ঐখানে এবং ঐ যুবকের কথা না বলে “অইখানে” ও “অই যুবকের” কথা কেন বললেন?
৩) জীবনানন্দ একই লাইনে “তাহার সাথে” এবং “তার সাথে” দুই ধরণের সর্বনাম কেন ব্যবহার করলেন?
৪)মৃত্তিকার মতো প্রিয়া আর ঘাস হয়ে যাওয়া প্রেম(শেষ স্তবকে হৃদয়) চিত্রকল্পটির মাধ্যমে তিনি আসলে কী
বুঝাতে চাইছেন?
৫) কবিতাটির শিরোনামটির মাজেজাই বা কী? (জীবনানন্দের প্রায় সব কবিতার শিরোনামই কবিতায় ব্যবহৃত
 কোন শব্দ থেকে নেয়া, কিন্তু লক্ষ্যনীয় “আকাশলীনা” শব্দটি মূল কবিতায় একবারও ব্যবহার হয় নি)
প্রথমেই বলে রাখি আমি বোদ্ধা নই, সমালোচকতো নই- ই। আমি জীবনানন্দের একজন সচেতন পাঠকমাত্র।
জীবনানন্দ গবেষক ও সমালোচকদের বক্তব্য পাঠ করে আমার কাছে মনে হয়েছে কবিতাটি ততটা সরল নয়-
যতটা প্রথম পাঠে মনে হয়। সুরঞ্জনা শব্দটির অর্থ আমি কোথাও খুঁজে পাই নি- এক জায়গার এর ব্যাখ্যায় বলা
হয়েছে বন্দিনী রাজকন্যা(প্রসঙ্গত বলে রাখি “কবিতা”পত্রিকায় প্রকাশের সময় কবিতাটিতে সুরঞ্জনা শব্দটির বদলে
“হৈমন্তিকী” শব্দটি ছিল; কবিতার শিরোনাম ছিল“ ও হৈমন্তিকী”) এদিক থেকে বলতে হয় সুরঞ্জনা শব্দটি এ কবিতায়
 নায়িকার রুপকমাত্র, নায়িকার নাম নয় কোনভাবেই। ঐখানের পরিবর্তে অইখানে ব্যবহার হয়েছে শুধুমাত্র
দূরত্বটুকু অনির্দিষ্ট করে দেবার স্বার্থেই, স্পষ্টতই অই শব্দটি ঐ এর চেয়ে অনেক বেশি অনিশ্চয়তা নির্দেশ করে।
 অনুরুপভাবে যুবকের নির্দেশক হিসেবে “অই” এর ব্যবহার যুবকটিকে অনির্দিষ্ট এবং একইসাথে যুবকটির সাথে
কবির অপরিচিতি নির্দেশ করে।
এখন কথা হচ্ছে যেহেতু যুবকটি অপরিচিত তাই “তাহার” ব্যবহার যুক্তিযুক্ত কিন্তু কোন যাদুবলে ঠিক পরমুহূর্তেই
যুবকটি কবির এত কাছের হয়ে যায় যে তিনি তাকে “তার” বলে সম্বোধন করেন? অন্যদিকে মৃত্তিকার সাথে ঘাসের
 অন্তরংগতা সুরঞ্জনার সাথে যুবকের অভিসার বর্ণনা করে এটা ধরে নিতে কোন বাধা নেই কিন্তু সর্বশেষ স্তবকে
কেন সুরঞ্জনার হৃদয় ঘাস হয়ে গেল আর শেষ দুলাইনে কেনই বা বেজে উঠল হাহাকার?
এই দুটি প্রশ্নের ব্যাখ্যায় যুবক শব্দটিকে মৃত্যুর বিকল্প হিসেবে ধরে নিলে জটিলতার কিছুটা নিরসন হয়। কীভাবে?
 বলছি-
আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, একেবারে কাছের কোন মানুষের মৃত্যুর শোক গ্রাস না করলে মৃত্যুকে
বেশ দূরেরই মনে হয়; অত্যন্ত আপন কাউকে বিদায় দেয়ার পরই উপলব্ধ হয় মৃত্যুই আমাদের সবচেয়ে কাছের
বন্ধু; প্রেমিকের কাছে আজীবন যুবতী প্রিয়া যার আলিঙ্গনে ধরা দিয়েছে সেই মৃত্যুকে যুবক মনে করলেই “তার”
 এবং “তাহার” বিষয়ক ধাঁধাঁর অবসান হয়। সুরঞ্জনার হৃদয়কে ঘাস আর অনন্ত হাহাকারের যৌক্তিকতাও আশা
 করি এখন পাঠকের বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না?
তবে অনেক “যদি”র এই পাঠ কিন্তু নতুন করে আরেকটি প্রশ্নের জন্ম দেয়। দ্বিতীয় স্তবকের শেষ লাইনে
“যেয়োনাক আর” এই “আর” শব্দটির আবির্ভাবেই সমস্ত ব্যাখ্যাটি তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়তে উদ্যত হয়।
তবে সুরঞ্জনার ইতিমধ্যে একবার মৃত্যু হয়েছে? তবে কি সুরঞ্জনার পূনর্জন্ম হয়েছে?
তাহলে কি দিনের পর দিন অসংখ্য লঘু মুহুর্তে প্রেমিকের কন্ঠে উচ্চারিত এ কবিতায় বিরহকে ছাপিয়ে যথারীতি
 মাথা উচিঁয়ে দাড়িঁইয়েছে জীবনানন্দীয় মৃত্যুময়তা?
কবিতার শিরোনাম (“আকাশলীনা”) সেই সম্ভাবনার দিকেই কি অঙ্গুলী নির্দেশ করে না?

Friday, 25 January 2013

সোনার তরী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


সোনার তরী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



গনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান-কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা–
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা॥
একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা—
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসী-মাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা—
এপারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা॥
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে!
দেখে যেন মনে হয়, চিনি উহারে।
ভরা পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু ধারে—
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে॥
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্‌ বিদেশে?
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও—
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে॥  
যত চাও তত লও তরণী-পরে।
আর আছে?— আর নাই, দিয়েছি ভরে॥
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে—
এখন আমারে লহো করুণা ক’রে॥
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহি নু পড়ি—
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী॥

নদী-স্বপ্ন – বুদ্ধদেব বসু


কোথায় চলেছো? এদিকে এসো না! দুটো কথা শোনা দিকি
এই নাও- এই চকচকে ছোটো, নুতন রূপোর সিকি
ছোকানুর কাছে দুটো আনি আছে, তোমারে দেবো গো তা-ও,
আমাদের যদি তোমার সঙ্গে নৌকায় তুলে নাও।
নৌকা তোমার ঘাটে বাঁধা আছে- যাবে কি অনেক দূরে?
পায়ে পড়ি, মাঝি, সাথে নিয়ে চলো মোরে আর ছোকানুরে
আমারে চেনো না? মোর নাম খোকা, ছোকানু আমার বোন
তোমার সঙ্গে বেড়াবো আমরা মেঘনা-পদ্মা-শোন।
দিদি মোরে ডাকে গোবিন্দচাঁদ, মা ডাকে চাঁদের আলো,
মাথা খাও, মাঝি, কথা রাখো! তুমি লক্ষী, মিষ্টি, ভালো!
বাবা বলেছেন, বড় হয়ে আমি হব বাঙলার লাট,
তখন তোমাকে দিয়ে দেব মোর ছেলেবেলাকার খাট।
চুপি-চুপি বলি, ঘুমিয়ে আছে মা, দিদি গেছে ইস্কুলে,
এই ফাঁকে মোরে-আর ছোকানুরে- নৌকোয়া লও তুলে।
কোন ভয় নেই – বাবার বকুনি তোমাকে হবে না খেতে
যত দোষ সব, আমার- না, আমি একা ল’ব মাথা পেতে।
নৌকো তোমার ডুবে যাবে নাকো, মোরা বেশি ভারি নই,
কিচ্ছু জিনিস নেবো না সঙ্গে কেবল ঝন্টু বই।
চমকালে কেন! ঝন্টু পুতুল, ঝন্টু মানুষ নয়,
একা ফেলে গেলে, ছোকানুরে ভেবে কাঁদিবে নিশ্চয়।
অনেক রঙের পাল আছে, মাঝি? বাদামী? সোনালী? লাল?
সবুজও? তা হলে সেটা দাও আজ, সোনালীটা দিয়ো কাল।
সবগুলো নদী দেখাবে কিন্তু। আগে চলো পদ্মায়,
দুপুরের রোদে রূপো ঝলমল সাদা জল উছলায়
শুয়ে’ শুয়ে’ – মোরা দেখিব আকাশ- আকাশ ম-স্ত বড়,
পৃথিবীর যত নীল রঙ- সব সেখানে করেছে জড়।
মায়ের পূজোর ঘরটির মত, একটু ময়লা নাই,
আকাশেরে কে যে ধোয় বারবার, তুমি কি জানো তা ভাই?
কালো-কালো পাখি বাঁকা ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলে যায় দূরে,
উঁচু থেকে ওরা দেখিতে কি পায় মোরে আর ছোকানুরে?
রূপোর নদীতে রূপোর ইলিশ- চোখ ঝলসানো আঁশ,
ওখানে দ্যাখো না- জালে বেঁধে জেলে তুলিয়াছে একরাশ।
ওটা চর বুঝি? একটু রাখো না, এ তো ভারি সুন্দর।
এ যেন নতুন কার্পেট বোনা! এই পদ্মার চর?
ছোকানু, চল রে, চান ক’রে আসি দিয়ে সাত-শোটা ডুব,
ঝাঁপায়ে-দাপায়ে টলটলে জলে নাইতে ফুর্তি খুব।
ইলিশ কিনলে? আঃ, বেশ বে তুমি খুব ভালো, মাঝি
উনুন ধরাও ছোকানু দেখাবে রান্নার কারসাজি।
খাওয়া হ’লো শেষ- আবার চলেছি, দুলছে ছোট্ট নাও,
হাল্কা নরম হাওয়ায় তোমার লাল পাল তুলে দাও।
আমর দু’জন দেখি ব’সে ব’সে আকাশ কত না নীল,
ছোট পাখি আরো ছোট হ’য়ে যায়- আকাশের মুখে তিল
সারাদিন গোলা, সূর্য লুকালো জলের তলার ঘরে,
সোনা হ’য়ে জ্বলে পদ্মার জল কালো হ’লো তার পরে।
সন্ধ্যার বুকে তারা ফুটে ওঠে- এবার নামাও পাল
গান ধরো, মাঝি; জলের শব্দ ঝুপঝুপ দেবে তাল।
ছোকানুর চোখ ঘুমে ঢুলে আসে- আমি ঠিক জেগে আছি,
গান গাওয়া হ’লে আমায় অনেক গল্প বলবে, মাঝি?
শুনতে-শুনতে আমিও ঘুমাই বিছানা বালিশ বিনা
– মাঝি, তুমি দেখো ছোকানুরে, ভাই, ও বড়োই ভীতু কিনা
আমার জন্য কিচ্ছু ভেবো না, আমিই তো বড়োই প্রায়,
ঝড় এলে ডেকো আমারে- ছোকানু যেন সুখে ঘুম যায়।

পথহারা – কাজী নজরুল ইসলাম



বেলা শেষে উদাস পথিক ভাবে,
সে যেন কোন অনেক দূরে যাবে -
উদাস পথিক ভাবে।
‘ঘরে এস’ সন্ধ্যা সবায় ডাকে,
‘নয় তোরে নয়’ বলে একা তাকে;
পথের পথিক পথেই বসে থাকে,
জানে না সে কে তাহারে চাবে।
উদাস পথিক ভাবে।
বনের ছায়া গভীর ভালোবেসে
আঁধার মাথায় দিগবধূদের কেশে,
ডাকতে বুঝি শ্যামল মেঘের দেশে
শৈলমূলে শৈলবালা নাবে -
উদাস পথিক ভাবে।
বাতি আনি রাতি আনার প্রীতি,
বধূর বুকে গোপন সুখের ভীতি,
বিজন ঘরে এখন সে গায় গীতি,
একলা থাকার গানখানি সে গাবে -
উদাস পথিক ভাবে।
হঠাৎ তাহার পথের রেখা হারায়
গহন বাঁধায় আঁধার-বাঁধা কারায়,
পথ-চাওয়া তার কাঁদে তারায় তারায়
আর কি পূবের পথের দেখা পাবে
উদাস পথিক ভাবে।

ফুল ফুটুক না ফুটুক – সুভাষ মুখোপাধ্যায়



ফুল ফুটুক না ফুটুক
ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।
শান-বাঁধানো ফুটপাথে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ
কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে
হাসছে।
ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।
আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়ে
তারপর খুলে -
মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে
তারপর তুলে -
যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে
যেন না ফেরে।
গায়ে হলুদ দেওয়া বিকেলে
একটা দুটো পয়সা পেলে
যে হরবোলা ছেলেটা
কোকিল ডাকতে ডাকতে যেত
– তাকে ডেকে নিয়ে গেছে দিনগুলো।
লাল কালিতে ছাপা হলদে চিঠির মত
আকাশটাকে মাথায় নিয়ে
এ-গলির এক কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে
রেলিঙে বুক চেপে ধ’রে
এই সব সাত-পাঁচ ভাবছিল -
ঠিক সেই সময়
চোখের মাথা খেয়ে গায়ে উড়ে এসে বসল
আ মরণ ! পোড়ারমুখ লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতি !
তারপর দড়াম করে দরজা বন্ধ হবার শব্দ।
অন্ধকারে মুখ চাপা দিয়ে
দড়িপাকানো সেই গাছ
তখন ও হাসছে।

অটোগ্রাফ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


খুলে আজ বলি , ওগো নব্য ,
নও তুমি পুরোপুরি সভ্য ।
জগৎটা যত লও চিনে
ভদ্র হতেছ দিনে দিনে ।
বলি তবু সত্য এ কথা —
বারো-আনা অভদ্রতা
কাপড়ে-চোপড়ে ঢাক ‘ তারে ,
ধরা তবু পড়ে বারে বারে ,
কথা যেই বার হয় মুখে
সন্দেহ যায় সেই চুকে ।
ডেস্কেতে দেখিলাম , মাতা
রেখেছেন অটোগ্রাফ-খাতা ।
আধুনিক রীতিটার ভানে
যেন সে তোমারই দাবি আনে ।
এ ঠকানো তোমার যে নয়
মনে মোর নাই সংশয় ।
সংসারে যারে বলে নাম
তার যে একটু নেই দাম
সে কথা কি কিছু ঢাকা আছে
শিশু ফিলজফারের কাছে ।
খোকা বলে , বোকা বলে কেউ —
তা নিয়ে কাঁদ না ভেউ-ভেউ ।
নাম-ভোলা খুশি নিয়ে আছ ,
নামের আদর নাহি যাচ ।
খাতাখানা মন্দ এ না গো
পাতা-ছেঁড়া কাজে যদি লাগ ।
আমার নামের অক্ষর
চোখে তব দেবে ঠোক্কর ।
ভাববে , এ বুড়োটার খেলা ,
আঁচড়-পাঁচড় কাটে মেলা ।
লজঞ্জুসের যত মূল্য
নাম মোর নহে তার তুল্য ।
তাই তো নিজেরে বলি , ধিক্‌ ,
তোমারই হিসাব-জ্ঞান ঠিক ।
বস্তু-অবস্তুর সেন্স্‌
খাঁটি তব , তার ডিফারেন্স্‌
পষ্ট তোমার কাছে খুবই —
তাই , হে লজঞ্জুস-লুভি ,
মতলব করি মনে মনে ,
খাতা থাক্‌ টেবিলের কোণে ।
বনমালী কো-অপেতে গেলে
টফি-চকোলেট যদি মেলে
কোনোমতে তবে অন্তত
মান রবে আজকের মতো ।
ছ বছর পরে নিয়ো খাতা ,
পোকায় না কাটে যদি পাতা ।

পাগলী, তোমার সঙ্গে… – জয় গোস্বামী


পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন
এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদা
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম।
অশান্তি চরমে তুলব, কাকচিল বসবে না বাড়িতে
তুমি ছুঁড়বে থালা বাটি, আমি ভাঙব কাঁচের বাসন
পাগলী, তোমার সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ৪২ কাটাব জীবন।
মেঘে মেঘে বেলা বাড়বে, ধনে পুত্রে লক্ষ্মী লোকসান
লোকাসান পুষিয়ে তুমি রাঁধবে মায়া প্রপন্ঞ্চ ব্যন্জ্ঞন
পাগলী, তোমার সঙ্গে দশকর্ম জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দিবানিদ্রা কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঝোলভাত জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে মাংসরুটি কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নিরক্ষর জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে চার অক্ষর কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে বই দেখব প্যারামাউন্ট হলে
মাঝে মাঝে মুখ বদলে একাডেমি রবীন্দ্রসদন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নাইট্যশালা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে কলাকেন্দ্র কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে বাবুঘাট জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দেশপ্রিয় কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে সদা সত্য জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ‘কী মিথ্যুক’ কাটাব জীবন।
এক হাতে উপায় করব, দুহাতে উড়িয়ে দেবে তুমি
রেস খেলব জুয়া ধরব ধারে কাটাব সহস্র রকম
লটারি, তোমার সঙ্গে ধনলক্ষ্মী জীবন কাটাব
লটারি, তোমার সঙ্গে মেঘধন কাটাব জীবন।
দেখতে দেখতে পুজো আসবে, দুনিয়া চিত্‍কার করবে সেল
দোকানে দোকানে খুঁজব রূপসাগরে অরূপরতন
পাগলী, তোমার সঙ্গে পুজোসংখ্যা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে রিডাকশনে কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে কাঁচা প্রুফ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ফুলপেজ কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে লে আউট জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে লে হালুয়া কাটাব জীবন।
কবিত্ব ফুড়ুত্‍ করবে, পিছু পিছু ছুটব না হা করে
বাড়ি ফিরে লিখে ফেলব বড়ো গল্প উপন্যাসোপম
পাগলী, তোমার সঙ্গে কথাশিল্প জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে বকবকম কাটাব জীবন।
নতুন মেয়ের সঙ্গে দেখা করব লুকিয়ে চুরিয়ে
ধরা পড়ব তোমার হাতে, বাড়ি ফিরে হেনস্তা চরম
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভ্যাবাচ্যাকা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে হেস্তনেস্ত কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে পাপবিদ্ধ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধর্মমতে কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে পুজা বেদি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে মধুমালা কাটাব জীবন।
দোঁহে মিলে টিভি দেখব, হাত দেখাতে যাব জ্যোতিষীকে
একুশটা উপোস থাকবে, ছাব্বিশটা ব্রত উদযাপন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভাড়া বাড়ি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে নিজ ফ্ল্যাট কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে শ্যাওড়াফুলি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে শ্যামনগর কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে রেল রোকো জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে লেট স্লিপ কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে আশাপূর্ণা জীবন কাটাব
আমি কিনব ফুল, তুমি ঘর সাজাবে যাবজ্জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় জওয়ান জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় কিষান কাটাব জীবন।
সন্ধেবেলা ঝগড়া হবে, হবে দুই বিছানা আলাদা
হপ্তা হপ্তা কথা বন্ধ মধ্যরাতে আচমকা মিলন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ব্রক্ষ্মচারী জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে আদম ইভ কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে রামরাজ্য জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে প্রজাতন্ত্রী কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ছাল চামড়া জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দাঁতে দাঁত কাটাব জীবন।
এর গায়ে কনুই মারব রাস্তা করব ওকে ধাক্কা দিয়ে
এটা ভাঙলে ওটা গড়ব, ঢেউ খেলব দু দশ কদম
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোঝড় জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ‘ভোর ভয়োঁ’ কাটাব জীবন।

আকাশে সাতটি তাঁরা > জীবনানন্দ দাশ


ছেলে: আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে
সে থাকি; বাংলার নীল সন্ধ্যা-কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে;
আমার চোখের পরে আমার মুখের পরে চুল তার ভাসে;
পৃথিবীর কোনো পথে কন্যারে দেখিনিকো-দেখি নাই অত
অজস্রচুলের চুমা হিজলে, কাঁঠালে , জামে ঝরে অবিরত,
জানি নাই এত স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে রূপসীর চুলের বিন্যাসে।

মেয়ে: পৃথিবীর কোনো পথে: নরম ধানের গন্ধ-কলমীর ঘ্রাণ,
কিশোরের পায়ের- দলা মুথাঘাস, – লাল লাল বটের ফলের
ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা- এরই মাঝে বাংলার প্রাণ
আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি পাই টের।

ছেলে: আবার আকাশে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে :
যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে
অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি, /সেই নারীর মতো
ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে।

মেয়ে: ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনী,
রামধনু রঙের কাচের জানালা,
ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায়
কক্ষ কক্ষান্তর থেকে আরো দুর কক্ষ কক্ষান্তরের
ক্ষণিক আভাস-

আয়ুহীন স্তব্ধতা বিস্ময়!
তোমার নগ্ন নির্জন হাত

ছেলে: রাতের বাতাস আসে
আকাশের নক্ষত্রগুলো জ্বলন্ত হয়ে ওঠে
যেন কারে ভালোবেসেছিলাম-
সমস্ত শরীর আকাশ রাত্রি নক্ষত্র-উজ্জ্বল হয়ে উঠছে তাই
আমি টের পাই সেই নগ্ন হাতের গন্ধের
সেই মহানুভব অনিঃশেষ আগুনের
রাতের বাতাসে শিখানীলাভ এই মানবহৃদয়ের
সেই অপর মানবীকে।
     
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে, বলিল:

মেয়ে: তোমারে চাই :
     
বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
     
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি- কুয়াশার পাখনায়-
সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক
জোনাকির দেহ হতে- খুঁজেছি তোমারে সেইখানে-

ছেলে: নতুন সৌন্দর্য এক দেখিয়াছি- সকল অতীত
ঝেড়ে ফেলে- নতুন বসন্ত এক এসেছে জীবনে ;
শালিখেরা কাঁপিতেছে মাঠে মাঠে- সেইখানে শীত
শীত শুধু- তবুও আমার বুকে হৃদয়ের বনে
কখন অঘ্রান রাত শেষ - পৌষ গেল লে
যাহারে পাইনি রোমে বেবিলনে, সে এসেছে লে।

মেয়ে: তুমি এই রাতের বাতাস ,বাতাসের সিন্ধু-ঢেউ
তোমার মতন কেউ নাই আর।
অন্ধকার নিঃসাড়তার  মাঝখানে
তুমি আনো প্রাণে .সমুদ্রের ভাষা,
ব্যথিত জলের মতন,
রাতের বাতাস তুমি,- বাতাসের সিন্ধু- ঢেউ,
তোমার মতন কেউ নাই আর।

ছেলে: তোমার মুখের দিকে তাকালে এখনো
আমি সেই পৃথিবীর সমুদ্রের নীল,
নক্ষত্র, রাত্রির জল, যুবাদের ক্রন্দন সব-
শ্যামলী, করেছি অনুভব।       
তোমার সৌন্দর্য নারি, অতীতের দানের মতন।
ধর্মাশোকের স্পষ্ট আহ্বানের মতো
আমাদের নিয়ে যায় ডেকে
     
তোমার মুখের স্নিগ্ধ প্রতিভার পানে।

মেয়ে: আমরা কিছু চেয়েছিলাম প্রিয়;
নক্ষত্র মেঘ আশা আলোর ঘরে
পৃথিবীর সূর্যসাগরে, ভেবেছিলাম,
পেয়ে যাবে প্রেমের স্পষ্ট গতি
সত্য সূর্যালোকের মতন;-

ছেলে: সবার ওপর তোমার আকাশপ্রতিম মুখে রয়েছে
সফল সকালের রৌদ্র।
সৃষ্টি সমাজের বিকেলের অন্ধকারের ভিতর
সকালবেলার প্রথম সূর্য-শিশিরের মতো সেই মুখ ;
জানে না কোথায় ছায়া পড়েছে আমার জীবনে,
সমস্ত অমৃতযোগের অন্তরীক্ষে।
আমাদের ভালোবাসা পথ কেটে নেবে এই পৃথিবীতে ;-
আমরা দুজনে এই বসে আছি আজ-ইচ্ছাহীন ;-
শালিক পায়রা মেঘ পড়ন্ত বেলার এই দিন
চারিদিকে ;-
এখানে গাছের পাতা যেতেছে হলুদ য়ে- নিঃশব্দে উল্কার মতো রে
    
একদিন তুমি এসে তবু এই হলুদ আঁচল রেখে ঘাসের ভিতরে শান্তি পাবে