অপূর্বদের বাড়ি অনেক ছিল চৌকি টেবিল , পাঁচটা-সাতটা গাড়ি ; ছিল কুকুর ; ছিল বেড়াল ; নানান রঙের ঘোড়া কিছু না হয় ছিল ছ-সাতজোড়া ; দেউরি-ভরা দোবে - চোবে , ছিল চাকর দাসী , ছিল সহিস বেহারা চাপরাসি । — আর ছিল এক মাসি । স্বামীটি তার সংসারে বৈরাগী , কেউ জানে না গেছেন কোথায় মোক্ষ পাবার লাগি স্ত্রীর হাতে তার ফেলে বালক দুটি ছেলে । অনাত্মীয়ের ঘরে গেলে স্বামীর বংশে নিন্দা লাগে পাছে তাই সে হেথায় আছে ধনী বোনের দ্বারে । একটিমাত্র চেষ্টা যে তার কী করে আপনারে মুছবে একেবারে । পাছে কারো চক্ষে পড়ে , পাছে তারে দেখে কেউ বা বলে ওঠে , “ আপদ জুটল কোথা থেকে ”— আস্তে চলে , আস্তে বলে , সবার চেয়ে জায়গা জোড়ে কম , সবার চেয়ে বেশি পরিশ্রম । কিন্তু যে তার কানাই বলাই নেহাত ছোট্ট ছেলে , তাদের তরে রেখেছিলেন মেলে বিধাতা যে প্রকান্ড এই ধরা ; অঙ্গে তাদের দুরন্ত প্রাণ , কণ্ঠ তাদের কলরবে ভরা । শিশুচিত্ত-উৎসধারা বন্ধ করে দিতে বিষম ব্যথা বাজে মায়ের চিতে । কাতর চোখে করুণ সুরে মা বলে , “ চুপ চুপ — ” একটু যদি চঞ্চলতা দেখায় কোনোরূপ । ক্ষুধা পেলে কান্না তাদের অসভ্যতা , তাদের মুখে মানায় নাকো চেঁচিয়ে কথা ; খুশি হলে রাখবে চাপি কোনোমতেই করবে নাকো লাফালাফি । অপূর্ব আর পূর্ণ ছিল এদের একবয়সী ; তাদের সঙ্গে খেলতে গেলে এরা হত পদে পদেই দোষী । তারা এদের মারত ধড়াধ্বড় ; এরা যদি উলটে দিত চড় , থাকত নাকো গন্ডগোলের সীমা — উভয় পক্ষের ই মা কানাই বলাই দোঁহার ‘ পরে পড়ত ঝড়ের মতো ,— বিষম কান্ড হত ডাইনে বাঁয়ে দু-ধার থেকে মারের ‘ পরে মেরে । বিনা দোষে শস্তি দিয়ে কোলের বাছাদেরে ঘরের দুয়ার বন্ধ করে মাসি থাকত উপবাসী — চোখের জলে বক্ষ যেত ভাসি । অবশেষে দুটি ছেলে মেনে নিল নিজেদের এই দশা । তখন তাদের চলাফেরা ওঠাবসা স্তব্ধ হল , শান্ত হল , হায় পাখিহারা পক্ষিনীড়ের প্রায় । এ সংসারে বেঁচে থাকার দাবি ভাঁটায় ভাঁটায় নেবে নেবে একেবারে তলায় গেল নাবি ; ঘুচে গেল ন্যায় - বিচারের আশা , রুদ্ধ হল নালিশ করার ভাষা । সকল দুঃখ দুটি ভায়ে করল পরিপাক নিঃশব্দ নির্বাক । চক্ষে আঁধার দেখত ক্ষুধার ঝোঁকে — পাছে খাবার না থাকে , আর পাছে মায়ের চোখে জল দেখা দেয় , তাই বাইরে কোথাও লুকিয়ে থাকত , বলত , “ ক্ষুধা নাই । ” অসুখ করলে দিত চাপা ; দেবতা মানুষ কারে একটুমাত্র জবাব করা ছাড়ল একেবারে । প্রথম যখন ইস্কুলেতে প্রাইজ পেল এরা ক্লাসে সবার সেরা , অপূর্ব আর পূর্ণ এল শূন্যহাতে বাড়ি । প্রমাদ গনি , দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ি মা ডেকে কয় কানাই বলাইয়েরে ,— “ ওরে বাছা , ওদের হাতেই দে রে তোদের প্রাইজ দুটি । তার পরে যা ছুটি খেলা করতে চৌধুরিদের ঘরে । সন্ধ্যা হলে পরে আসিস ফিরে , প্রাইজ পেলি কেউ যেন না শোনে । ” এই বলে মা নিয়ে ঘরের কোণে দুটি আসন পেতে আপন হাতের খইয়ের মোওয়া দিল তাদের খেতে । এমনি করে অপমানের তলে দুঃখদহন বহন করে দুটি ভাইয়ে মানুষ হয়ে চলে । এই জীবনের ভার যত হালকা হতে পারে করলে এরা চূড়ান্ত তাহার । সবার চেয়ে ব্যথা এদের মায়ের অসম্মান — আগুন তারি শিখার সমান জ্বলছে এদের প্রাণ - প্রদীপের মুখে । সেই আলোটি দোঁহায় দুঃখে সুখে যাচ্ছে নিয়ে একটি লক্ষ্যপানে — জননীরে করবে জয়ী সকল মনে প্রাণে । কানাই বলাই কালেজেতে পড়ছে দুটি ভাই । এমন সময় গোপনে এক রাতে অপূর্ব তার মায়ের বাক্স ভাঙল আপন হাতে , করল চুরি পান্নামোতির হার ; থিয়েটারের শখ চেপেছে তার । পুলিস-ডাকাডাকি নিয়ে পাড়া যেন ভূমিকম্পে নড়ে ; যখন ধরা পড়ে-পড়ে অপূর্ব সেই মোতির মালাটিরে ধীরে ধীরে কানাইদাদার শোবার ঘরে বালিশ দিয়ে ঢেকে লুকিয়ে দিল রেখে । যখন বাহির হল শেষে সবাই বললে এসে — “ তাই না শাস্ত্রে করে মানা দুধে কলায় পুষতে সাপের ছানা । ছেলেমানুষ , দোষ কী ওদের , মা আছে এর তলে । ভালো করলে মন্দ ঘটে কলিকালের ফলে । ” কানাই বলাই জ্বলে ওঠে প্রলয়বহ্নিপ্রায় , খুনোখুনি করতে ছুটে যায় । মা বললেন , “ আছেন ভগবান , নির্দোষীদের অপমানে তাঁরি অপমান । ” দুই ছেলেরে সঙ্গে নিয়ে বাহির হলেন মাসি ; রইল চেয়ে দোবে চোবে , রইল চেয়ে সকল চাকর দাসী , ঘোড়ার সহিস বেহারা চাপরাসি । অপমানের তীব্র আলোক জ্বেলে মাকে নিয়ে দুটি ছেলে পার হল ঘোর দুঃখদশা চলে চলে কঠিন কাঁটার পথে । কানাই বলাই মস্ত উকিল বড়ো আদালতে । মনের মত বউ এসেছে , একটি-দুটি আসছে নাতনী নাতি ,— জুটল মেলা সুখের দিনের সাথি । মা বললেন , “ মিটবে এবার চিরদিনের আশ — মরার আগে করব কাশীবাস । ' অবশেষে একদা আশ্বিনে পুজোর ছুটির দিনে মনের মতো বাড়ি দেখে দুই ভাইয়েতে মাকে নিয়ে তীর্থে এল রেখে । বছরখানেক না পেরোতেই শ্রাবণমাসের শেষে হঠাৎ কখন মা ফিরলেন দেশে । বাড়িসুদ্ধ অবাক সবাই — মা বললেন , “ তোরা আমার ছেলে তোদের এমন বুদ্ধি হল , অপূর্বকে পুরতে দিবি জেলে ?” কানাই বললে , “ তোমার ছেলে বলেই তোমার অপমানের জ্বালা মনের মধ্যে নিত্য আছে জ্বলেই । মিথ্যে চুরির দাগা দিয়ে সবার চোখের ‘ পরে আমার মাকে ঘরের বাহির করে সেই কথাটা এ জীবনে ভুলি যদি তবে মহাপাতক হবে । ” মা বললেন , “ ভুলবি কেন ; মনে যদি থাকে তাহার তাপ তাহলে কি তেমন ভীষণ অপমানের চাপ চাপানো যায় আর কাহারো ‘ পরে বাইরে কিংবা ঘরে । মনে কি নেই সেদিন যখন দেউ ড়ি দিয়ে বেরিয়ে এলেম তোদের দুটি সঙ্গে নিয়ে তখন আমার মনে হল যদি আমি স্বপ্নমাত্র হই জেগে দেখি আমি যদি কোথাও কিছু নই তা হলে হয় ভালো । মনে হল শত্রু আমার আকাশভরা আলো , দেবতা আমার শত্রু , আমার শত্রু বসুন্ধরা — মাটির ডালি আমার অসীম লজ্জা দিয়ে ভরা । তাইতো বলি বিশ্বজোড়া সে লাঞ্ছনা তেমন করে পায় না যেন কোনো জনা বিধির কাছে এই করি প্রার্থনা । ” ব্যাপারটা কী ঘটেছিল অল্প লোকেই জানে , বলে রাখি সেকথা এইখানে । বারো বছর পরে অপূর্ব রায় দেখা দিল কানাইদাদার ঘরে । একে একে তিনটে থিয়েটার ভাঙাগড়া শেষ করে সে হল ক্যাশিয়ার সদাগরের আপিসেতে । সেখানে আজ শেষে তবিল-ভাঙার জাল হিসাবে দায়ে ঠেকেছে সে । হাতে বেড়ি পড়ল বুঝি ; তাই সে এল ছুটে উকিল দাদার ঘরে , সেথায় পড়ল মাথা কুটে । কানাই বললে , “ মনে কি নেই ?” অপূর্ব কয় নতমুখে “ অনেকদিন সে গেছে চুকেবুকে । ” “ চুকে গেছে ?” কানাই উঠল বিষম রাগে জ্বলে , “ এতদিনের পর যেন আশা হচ্ছে চুকে যাবে বলে । ” নিচের তলায় বলাই আপিস করে — অপূর্ব রায় ভয়ে ভয়ে ঢুকল তারি ঘরে । বললে , “ আমায় রক্ষা করো । ” বলাই কেঁপে উঠল থরো থরো । অধিক কথা কয় না সে যে ; ঘন্টা নেড়ে ডাকল দারোয়ানে । অপূর্ব তার মেজাজ দেখে বে রিয়ে এল মানে মানে । অপূর্বদের মা তিনি হন মস্ত ঘরের গৃহিণী যে ; এদের ঘরে নিজে আসতে গেলে হয় যে তাঁদের মাথা নত । অনেক রকম করে ইতস্তত পত্র দিয়ে পূর্ণকে তাই পাঠিয়ে দিলেন কাশী । পূর্ণ বললে , “ রক্ষা করো মাসি । ” এরি পরে কাশী থেকে মা আসলেন ফিরে । কানাই তাঁরে বললে ধীরে ধীরে — “ জান তো মা , তোমার বাক্য মোদের শিরোধার্য , এটা কিন্তু নিতান্ত অকার্য । বিধি তাদের দেবেন শাস্তি , আমরা করব রক্ষে , উচিত নয় মা সেটা কারো পক্ষে । ” কানাই যদি নরম হয় বা , বলাই রইল রুখে অপ্রসন্ন মুখে । বললে , “ হেথায় নিজে এসে মাসি তোমার পড়ুন পায়ে ধরে দেখব তখন বিবেচনা করে । ” মা বললেন , “ তোরা বলিস কী এ । একটা দুঃখ দূর করতে গিয়ে আরেক দুঃখে বিদ্ধ করবি মর্ম! এই কি তোদের ধর্ম! ” এত বলি বাহির হয়ে চলেন তাড়াতাড়ি ; তারা বলে , “ যাচ্ছ কোথায় । ” মা বললেন , “ অপূর্বদের বাড়ি । দুঃখে তাদের বক্ষ আমার ফাটে ; রইব আমি তাদের ঘরে যতদিন না বিপদ তাদের কাটে । ” “ রো সো , রো সো , থামো , থামো , করছ এ কী । আচ্ছা , ভেবে দেখি । তোমার ইচ্ছা যবে আচ্ছা না হয় যা বলছ তাই হবে । ” আর কি থামেন তিনি ? গেলেন একীকিনী অপূর্বদের ঘরে তাদের মাসি । ছিল না আর দোবে চোবে , ছিল না চাপরাসি । প্রণাম করল লুটিয়ে পায়ে বিপিনের মা , পুরোনো সেই দাসী ।
Welcome to my personal website Campusbangla.com I am still developing this site day by day with new contains ( Bangla pdf Books, Kobita and other materials.). As a web developer I will be successful if someone visit my site and like as well. I am trying to portray Bengali culture through my site.
Saturday, 19 January 2013
মায়ের সম্মান ( কাব্যগ্রন্থ » পলাতকা ) » রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment